পাঠাভিজ্ঞতা --বই - "স্রোতোবক্ষে রাখিব মর্মর ধরণ - কবিতাসংকলন" - সন্মাত্রানন্দ - by Suhita Bhattacharyaya ( Sem 1 4 years Major/2023-24)


 

বইয়ের পাঠানুভূতি লেখা আমার পক্ষে বেশ কঠিন কাজ। সে যেকোনো ধরনের বই হোক না কেন। কোনো বইয়ের কথাবিশ্ব রচনা করার আগে তার কেন্দ্রে থাকা যে নিরবয়ব চিন্তা পূর্বতঃসিদ্ধভাবে সঞ্চিত হয়ে থাকে কথাকারের চেতনায়, তার ব্যাসকূটগুলি (আমার মনে হয়) কবিতার মতোই জটিল ও মননশীল ব্যক্তির নিকট সুস্বাদু, তার ছন্দোবদ্ধ প্রশ্নগুলি কাব্যের ছন্দের মতোই পাঠক ও কথাকার - উভয়ের ভাবজগৎকে আন্দোলিত করে। প্রকাশে তার রূপ হতেই পারে ছোটগল্প বা উপন্যাস বা প্রবন্ধ। কিন্তু অন্তঃশীল পরিচয়ে প্রত্যেক রসোত্তীর্ণ লেখাই কবিতা। আর কথানিহিত যে কবিতাবোধ, সে এমন এক জিনিস, তার কাছে মূক হয়ে যেতেই হয়। আর এই কথানিহিত কবিতাবোধের প্রকাশ যদি হয় কবিতাতেই, তবে কী হয়? মানুষের অতখানি মূক হওয়ার ক্ষমতা নেই যে। সেই মুগ্ধ প্রগলভতাতেই আজ এসব লিখতে বসেছি। 

 

      লিখতে বসে ভাবছি -- বেদনা, শূন্যতা, প্রেম, হতাশা, সমসাময়িক একাকিত্ববোধ থেকে প্রাকৃত অতীতের কথাকাকলি -- এই সবকিছুর বোধ কত তীব্র হলে; এত পরস্পরবিরোধী, অসরল বিষয়গুলোকে কতটা সরল অনুভূতির সুতোয় বাঁধতে পারলে তবে এমন কবিতা লেখা যায়! অথচ কী সহজ এই কবিতাগুলি রচনার বিষয়ে কবির উক্তি : "আবহমান বাংলা কবিতার স্রোতঃপথে দুয়েকটি শুকনো পাতা উড়ে গিয়ে পড়ে। তাদের মর্মরধ্বনি মিশে যায় কবিতার নদীস্রোতে। আমার এ কবিতাগুলির তাৎপর্য অতটুকুই।... ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, অনুভব ও স্মৃতির মূল্যেই এদের মূল্য দিয়েছি, তার বেশি কিছু জানি না।.." (ব্লার্ব থেকে)

সুতরাং, বইয়ের নামকরণ ও ব্লার্ব থেকে বোঝা যায়, বাংলাভাষার বহুতর কাব্যস্রোতে একখানি হলুদ পাতা ভাসিয়ে দিলেন কবি -- অর্থাৎ, পাঠক ও শব্দশিল্পীর ওতপ্রোত সম্পর্ককে যেমন স্বীকার করে নিলেন, তেমনই স্বীকার করে নিলেন সহস্র মানুষের সম্মিলিত অন্তহীন চিন্তনপ্রবাহের অস্তিত্বের কথা। আমার ব্যক্তিগতভাবে ভাবতে ইচ্ছে করে, বড়ো কাব্যিকভাবে বৌদ্ধদর্শনের বিজ্ঞানপ্রবাহের ধারণাকে ব্যবহার করেছেন তিনি। 

 

      প্রথম কবিতা 'যাপন'-এ কবি ধরেছেন ব্যক্তিকাল কীভাবে ভেঙে দেয় ব্যক্তিকাল, একজনের যাপন এসে কীভাবে তছনছ করে দেয় আরেকজনের যাপন। কখনো মানুষ নিজের যাপন ভাঙে নিজেই। এই আজব পৃথিবীতে 'এই অদ্ভুত এই মজার বাড়িটাতে আটকে' থাকা কত হাজার যুগ, কেবল নিস্তরঙ্গ এক শান্তির আশায়। শান্তি কি আমরাও খুঁজছি না নিজেদের মতো করে? নাকি 'এলেবেলে' কবিতায় যে কষ্ট রেখেছেন কবি, তার কোনো অভিজ্ঞতা আমাদের নেই? আমাদেরও তো একটা করে নিজস্ব গল্প আছে, হয়তো এই জনমে তা আর বলা হলো না, সেই অপ্রকাশের ব্যথা দেখতে পেয়ে যান কবি -- "এজন্মে নয়, আমারও যে গল্প একটা আছে/সেসব নাহয় লিখব ফিরে এলে।" বারবার জীবনে ফিরে ফিরে এসে জীবনকে দেখার ইচ্ছা কবিকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়, উনি দুঃখ চান, দুঃখের অণুবীক্ষণে দেখতে চান জীবনের জটিল চলন। মায়াঘন বর্ষার রাতের মতো দুটি চোখ চান - "দুঃখনিবৃত্তি আমার চাই না। আমি শুধু দুঃখের মেঘের ভিতর দিয়ে দেখতে চাই ওই দুটি কাজলকালো চোখের মায়াবী দৃষ্টি।" আবার "সমুদ্রগুপ্তের সহিস" কবিতায় দেখি ইতিহাসখ্যাত প্রবল প্রতাপান্বিত সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের সহিস তিষ্যর কথা, অতীতের প্রাকৃতজনের কথা কবির মনে পড়ে হাল আমলের কলকাতার রুবির মোড়ে এক অটোচালককে দেখে। দুজনে অভেদ? মৃত্যু আর কালের মধ্য দিয়ে হেঁটে এসেছে শুধু? বর্তমান ব্যক্তিপরিচয় তবে কতটা গভীরে প্রোথিত? আদতে সত্তার সুস্থির পরিচয় আছে কি কোথাও? প্রশ্ন জাগে।

      কখনো কখনো নিজেকে অন্তর্মুখী করে কোলাহল থেকে সরিয়ে আনেন নিজেকে "মেলাফেরতা পথে"র মতো কবিতায়, তখন কবিকিশোরের কিশোরী হয় বা বুঝি কিরাতভূমির 'পরে অনাদিকাল বয়ে চলা মনুনদীখানি। আবার কুণ্ঠিত হন না "অসূয়ার অবতারদের প্রতি" কথাকষা প্রয়োগে। "আমার অসুস্থ ভাইয়ের জন্য" কবিতায় ক্ষমা চাওয়ার মধ্যে যে শ্লেষ রেখে যান সমাজের প্রতি, তা এড়ানো যায় না। 

 

      অবশেষে অনেক শব্দ, প্রতিবাদ, চিত্র, অনুভূতি, সত্তালগ্ন বেদনাবোধ পেরিয়ে বই শেষ হয়ে আসে। যেন কোনো বৃহত্তর সাধনার আপ্তির ক্ষণ আসে এগিয়ে। কবি এতক্ষণে জাগতিক ঘাতপ্রতিঘাতের স্তর থেকে বহু উপরে : "কিন্তু আমাকে আঘাত করা কঠিন।/কারণ, আমি কখনই আঘাতকারীর সমস্তরে আসব না।" তারপর কোনো এক শব্দদীপ নিভে যাওয়া নীরব রাত্রিকালে ওনার 'মন বিতর্কবিমুখ, অবলীন --/ নিজ অনুভবে'। উনি বুঝিয়ে দেন, মানুষের এই সুপ্রবল কথাবাক্যের আস্ফালন হাস্যকর অস্মিতা মাত্র। মৃত্যু এসে কেড়ে নেয় সব। এই ঈর্ষাবিষ, ছদ্মরূপতা -- সব এক লহমায় নিভে যায়। কেবল থাকে কথাতীত অনুভব। এই কি কবিতার আদি তত্ত্ব? কবিতা কি সেটাই যেটা আসলে লেখাই হয়ে ওঠে না কোনোদিন? কে জানে। "শেষ হয়েও হইল না শেষ।"

 

      সত্যি বলছি, এইরকম কয়েকটা বইয়ের সাথে সারাজীবন বেঁচে থাকা যায়।

Comments

Popular posts from this blog

"THE HOUSE OF CARDS "- ANISHA BARIK [English Hons( Session -2018-2021)]