Saturday, 13 January 2024

এক প্রতিবাদী নারীর কাহিনী --- স্নেহা ঘোষ ( Sneha Ghosh- Sem 3)

 

রামগড় নামক এক জায়গায় এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ বাস করতেন সংসার তাঁদের খুবই অভাব অনটনের মধ্যে চলতবাড়িতে থাকার মধ্যে ছিল তাঁর স্ত্রী এবং একমাত্র কন্যা উপাসনা উপাসনা স্বভাবে বড়ো ভালো, দয়ালু, সাহসী, চরিত্রবতী, নিষ্ঠাবতী একটি মেয়ে তাঁর সবথেকে বড়ো লক্ষনীয় বৈশিষ্ট্য হল সে কখনো মিথ্যা কথা বলে না সর্বদা সত্য কথা বলে রামগড়ের বিখ্যাত জমিদার ধনঞ্জয় সেন তাঁর বাড়ির কূলদেবী কালী মাতার পূজারী ছিলেন উপাসনার পিতা দরিদ্র ব্রাক্ষ্মণ ভূষণ একদিন, উপাসনার পিতার শরীর খারাপ থাকার কারণে সে জমিদার বাড়ি যায় সেই খবর দিতে যে আজ তাঁর পিতা পুজো করতে আসতে পারবে না  জমিদার ধনঞ্জয় সেন বাড়িতে না থাকার দরুন তাঁর জেষ্ঠ্য পুত্র হিমাংশু সেন কে উপাসনা বলে আসেন তাঁর  পিতার আজ না আসার কথা

        এদিকে হিমাংশুর প্রথম দেখাতেই উপাসনাকে ভালো লেগে যায়; উপাসনার সোজাসাপ্টা কথা, হাসি; হিমাংশুকে বড়ো আকৃষ্ট করে সবথেকে তাঁর ভালো লাগে উপাসনার মায়া ভরা দুটি চোখ সেই রাতে হিমাংশুর কিছুতেই ঘুম আসে না, বারে বারে মনে পড়ে তাঁর উপাসনার কথা এভাবে দিন গড়িয়ে যায় আবারও একদিন উপাসনার সাথে তাঁর রাস্তাতে দেখা হয় এবং তারপর থেকে তারা প্রচুর গল্প, সময় কাটানো, একসাথে ঘুরে বেড়াতে শুরু করে আস্তে আস্তে দুজনেই একে অপরকে ভালবাসতে শুরু করে শেষমেষ এই খবর জমিদার বাড়িতে পৌছালে পিতা ধনঞ্জয় সেন, হিমাংশুকে, উপাসনা কে ভুলে যেতে বলে কিন্তু, হিমাংশু তাঁর পিতার কথা অমান্য করে বলেন যে সে বিয়ে করলে শুধুমাত্র উপাসনাকেই করতে চায় নাহলে সে আত্মহত্যা করবে  পুত্রের এই কথা শুনে ধনঞ্জয় সেন ছেলে হারানোর ভয়ে তিনি হিমাংশুর দেওয়া প্রস্তাব মেনে নেন এবং উপাসনাকেই বাড়ির পুত্রবধূ হিসেবে নিয়ে আসতে চান

একদা এক সন্ধ্যাবেলায়, জমিদার ধনঞ্জয় সেন ও তার জেষ্ঠ্য পুত্র হিমাংশু সেন উপাসনার পিতার গৃহে এসে হাজির তাদের অবস্থা এতটাই করুণীয় যে বাইরের লোককে বসতে দেওয়ার মতো জায়গাও নেই উপাসনার মা নীলাম্বরী দেবী তাদের প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে কাপ, প্লেট, নিয়ে এসে বাড়িতে আসা অতিথিদের জন্য কিছু জলখাবারের ব্যবস্থা করেন এমতাবস্থায়, বাড়ির অবস্থা দেখে বড়ো বিরক্ত হন জমিদার ধনঞ্জয় সেন হিমাংশু চা খেতে খেতে তাঁর হাত থেকে কাপটি পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলে; উপাসনা জোরেই বলে ওঠে, “ আরে, আস্তে আস্তে এটা আমাদের কাপ, প্লেট নয় আমাদের প্রতিবেশীর, ভেঙে গেলে আমরা ওদের কী জবাব দেব? “  একথা শুনে হিমাংশু হেসে ওঠে আর তাঁর পিতা প্রথমে বিরক্ত প্রকাশ করলেও পরে একটি জিনিস দেখে বেশ খুশি ড়য় যে, মেয়েটি বড়োই  সরল, সাদাসিধে, সাহসী, সত্য কথা বলতে একবারও পিছুপা হয় না

এই লক্ষন ধনঞ্জয় সেন কে বড়োই সন্তুষ্টি দেয় বিয়ের তারিখ শীঘ্রই ঠিক হয়ে যায় ১৭ই মাঘ, ১৪৯২ সন উপাসনা এবং হিমাংশু বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় এবং উপাসনা সেন বাড়ির পুত্রবধূ হিসেবে প্রবেশ করে্ ওই বাড়িতে প্রথম থেকেই বাড়ির অন্য সদস্যরা উপাসনাকে মেনে নেননি, যেহেতু, সে গরিব পরিবারের মেয়ে  সারাদিন বাড়ির অন্য সদস্যদের কাছ্ থেকে লাঞ্ছনা, কটু কথা, অপমানিত হতে হতো কিন্তু, একমাত্র হিমাংশুই তাকে কোনদিন কোনো খারাপ কথা বা গায়ে হাত তোলা কোনদিনই কিছু করেনি হিমাংশু উপাসনাকে বড়োই ভালোবাসত সে উপাসনার জন্য সমস্ত পরিবারের বিরুদ্ধেও কথা বলত সে উপাসনার জন্য সমস্ত কিছু করতে পারত এভাবেই উপাসনা আর হিমাংশুর নতুন সংসার জীবন বেশ ভালোই কাটছিল

হঠাৎ একদিন….. হোলির দিনে ঘটল এক ঘটনা তাদের বাড়ির কাজের মেয়ে মিনতি রং হাতে নিয়ে আসছিলো উপাসনাকে মাখাবে বলে কিন্তু, সেই সময় হঠাৎ হিমাংশুর কাকার ছেলে অংশুমান নেশাগ্রস্ত অবস্থায় মিনতি কে টানাটানি করে সে, এবং তার চরিত্রহীন বন্ধুরা সবাই মিলে তাকে ধর্ষণ করে এই ঘটনাটি পুরোটা উপাসনা নিজের চোখে দেখে ফেলে, মিনতি কে বাঁচানোর চেষ্টা করলেও অংশুমান তাকে খারাপ প্রস্তাব দেয় যার ফলে উপাসনা লজ্জায় সেখান থেকে চলে যেতে বাধ্য হয় কিন্তু সে থেমে থাকে না মিনতি কে নিয়ে থানায় গিয়ে অংশুমানের বিরুদ্ধে কেস করে মিনতি শ্লীলতাহানির জন্য এবং সে বলে সে নিজে দেবে সাক্ষী, যেহেতু সে প্রতক্ষ্যদর্শী ওই ঘটনার খবরটা জমিদার বাড়িতে জানাজানি হয়ে যায় এবং বাড়িতে নোটিশ আসে অংশুমান কে পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় এদিকে, অংশুমানের পিতা মৃত্যুঞ্জয় সেন অর্থাৎ, ধনঞ্জয় সেনের ভ্রাতা এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা উপাসনা কে মেরে ফেলার চেষ্টা করে যাতে সে কোর্টে গিয়ে সাক্ষী দিতে না পারে এবং অংশুমানের সাক্ষীর অভাবে খুব সহজেই ছাড়া পেয়ে যায়

তারপর থেকে উপাসনার উপর অত্যাচার আরো দিনদিন বেড়ে যেতে লাগল তাকে মানসিকভাবে পাগল করে দেওয়ারও প্ররোচনা শুরু হলো সবদিক দিয়ে তারা উপাসনাকে পাগল প্রমাণ করলো এবং হিমাংশুর অনিচ্ছার বিরুদ্ধে বাড়ির সবাই উপাসনাকে পাগলাগারদে পাঠিয়ে দেয় উপাসনা পুরোপুরি সুস্থ ছিল তাকে মানসিকভাবে অসুস্থ করে রাখার জন্য পাগলাগারদে সারাদিন তাকে কারেন্টের শক্ দেওয়া হতো বিভিন্ন ভাবে অত্যাচার করা হতো সমস্ত কিছু মুখ বুজে সহ্য করে একদিন সুযোগ বুঝে পাগলাগারদ থেকে পালিয়ে যায় উপাসনা এই খবর জমিদার বাড়ি এসে পৌঁছালে তারা আবার নতুন ষড়যন্ত্র শুরু করে দেয় উপাসনা কে হাতের নাগালে আনার

এদিকে উপাসনা পাগলাগারদ থেকে বেরিয়ে এক অচেনা পাড়ায় চলে আসে যেখানে আবার তার পিছু নেয় কিছু মাতাল লোক সেখান থেকে বাঁচায় তাকে তাঁর ই  ছোটোবেলার এক বন্ধু রাহুল তখন সে এই অবস্থায় উপাসনা কে দেখে সমস্ত কথা জিজ্ঞাসা করতে উপাসনা প্রথম থেকে হওয়া সমস্ত ঘটনা রাহুল কে খুলে বলে উপাসনা যখন রাহুলের খবর জানতে চায়, তখন রাহুল বলে যে সে পেশায় একজন উকিল তাঁর স্ত্রী ও কন্যা কেও তার পরিবারের লোকেরা ষড়যন্ত্র করে মেরে ফেলে, এরপরে আইনের সাহায্য নিলেও আইন তাকে সাহায্য করেনি যেহেতু রাহুল তাঁর পরিবারের অমতে বিয়ে করেছিল তারপর থেকে রাহুল উকিল পদ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয় এবং আইনের প্রতি যে তার  আলাদা শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ছিল তাও নষ্ট হয়ে যায় সব শুনে উপাসনা বলে তাহলে এই বিপদ থেকে আমাকে কে বাঁচাবে? আমি চাই সমাজের সকল ধর্ষকরা ভয় পায় আর কোন মেয়ের গায়ে হাত দিতে অনেক অনুনয় বিনয় করার পর রাহুল, উপাসনা কে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেয় যথাসময়ে তাকে কোর্টে হাজির হতে বলে রাহুল

কোর্টে যাওয়ার দিনে, সেন পরিবারের ছোট ছেলে মৃত্যুঞ্জয় সেন লোক পাঠান উপাসনা কে মেরে ফেলার জন্য কিন্তু, প্রতিটি পদক্ষেপে রাহুল তাকে সাহায্য করে এবং উপাসনা সমস্ত প্রতিকূলতা কাটিয়ে শেষমেশ কোর্টে পৌছায় এবং পুরো ঘটনা ধর্মাবতার কে খুলে বলেন এবং সে যে পাগল নয়, তাঁর পরিবারের লোকেরা যে তাকে পাগল বানাতে চেয়েছিল তাও প্রমাণ করে দেয় যার ফলে, সেন পরিবারের ছোট ছেলে মৃত্যুঞ্জয় সেন ও তাঁর স্ত্রী, অংশুমান ও তাঁর বন্ধুদের সবার ১৪ বছরের কারাদণ্ড হয় এবং এই অপরাধমূলক কাজের জন্য জমিদারীর উইল থেকে তাদের নামও বরখাস্ত করে দেয় সেন পরিবারের প্রধান ধনঞ্জয় সেন উপাসনার কাছে হিমাংশু ও ধনঞ্জয় ক্ষমা চেয়ে নেয় তাদের মূল বোঝার জন্য এবং উপাসনা কে তাঁর এই লড়াই এ সাহায্য করতে না পারার জন্য

আসলে আমাদের সমাজে অংশুমানের মতো প্রচুর ভাইরাস ঘুরে বেড়াচ্ছে শুধুমাত্র মেয়েদের ক্ষতি করার জন্য আমাদের উচিত নিজেদেরকে উপাসনার মতো তৈরি করা যাতে সমস্ত দুর্যোগের মোকাবিলা করে আসল দোষীদের শাস্তি দিতে পারি আর এর জন্য প্রয়োজন কঠোর মনোবল, সাহসী মানসিকতা এবং প্রতিবাদী মনের  একটা কথা আমাদের সবার মনে রাখা প্রয়োজন----- সত্যের জয় সর্বদাই

যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানি র্ভবতি ভারত

অভ্যুত্থানম অধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম।।

পরিত্রাণায় হি সাধুনাং বিনাশয় চ দুষ্কৃতাম

ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবানি যুগে যুগে।।

No comments:

Post a Comment